প্রতিদিনই সূর্যোদয় হয়। দিন শেষে রাত আসে। রাত্রি শেষে প্রভাতের রক্তিম আভা প্রকাশিত হলেই মানুষ ভুলে যায় পূর্বের দিনটিকে। কিন্তু কিছু কিছু দিন আছে যে দিনটি কেউ ভুলতে পারে না ভুলে যায় না । যুগ যুগান্তরে ইতিহাসের পাতায় রয়ে যায় দিনটি। একুশে ফেব্রুয়ারি তেমনি একটি দিন বাঙ্গালীর ইতিহাসে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বীজ বপিত হয়েছিল এই দিনে। এই দিনের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের জাতিগত স্বকীয়তার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের এই দিনে সারা পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে মাতৃভাষার মান রক্ষার জন্য বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দেয় সালাম, বরকত, রফিকসহ আরো অনেকে। বিশ্বের বুকে এই প্রথম কোন জাতি তাদের ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য নিজের জীবনকে বিসর্জন দিল। এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতিও মিলল বিশ্বে। ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সারা পৃথিবীর মানুষ ভাষা শহীদদেরকে নত মস্তকে স্মরণ করে এই দিনে । বাঙ্গালীর জন্য এই দিনটি গৌরবের।
তবে প্রশ্ন হল যে, ভাষার জন্য আমাদের পূর্ব পুরুষরা জীবন দান করে গেলেন আমরা সেই ভাষার প্রতি কতটুকু যত্নবান? নাকি আমরা শুধু ২১ ফেব্রুয়ারির আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? বর্তমানে আমাদের দেশের কিছু টেলিভিশন ও বেতার কেন্দ্রগুলো প্রতিযোগিতামূলক ভাবে বাংলা ভাষার বিকৃত চর্চা করছে। তারা বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে নতুন বাংলিশ বা বাংরেজি ভাষার চর্চা করছে। দ্বিধাহীন ভাবে তারা বাংলাকে ইংরেজি উচ্চারণে বলে যাচ্ছে এবং আমরা গণমাধ্যমের এই বিকৃত চর্চাকে আধুনিকতার মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করেছি। বাংলার সাথে ইংরেজি শব্দ না মিশিয়ে আমরা কথা বলতে পারি না। কারো কথা বলার মাঝে ইংরেজি শব্দ না থাকলে তাকে অগাচণ্ডী মনে হয়। আর এর মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছে অনেক বাংলা শব্দ। যার প্রমাণ আমরা কথা বলার সময় পাই। কথা-বার্তার মাঝে কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি যেগুলোর বাংলা আমরা জানিনা। এভাবে লাগামহীন ভাবে ইংরেজি এবং হিন্দি মিশ্রিত বাংলা ভাষার চর্চা চলতে থাকলে আমাদের মাতৃভাষা তার স্বকীয়তা হারাবে। সেই সাথে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব সংকটে পড়ব।
বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ব্যবহারের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আইন করে কি এ ভাষার প্রয়োগ হয়! এজন্য চাই ভাষা ব্যবহারকারীদের ভাষার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা এবং সদিচ্ছা। প্রতি বছর আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করি। ভাষা শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের সম্মানে খালি পায়ে হেঁটে গিয়ে পুষ্পাধার প্রদান করি। কিন্তু ভাষা দিবসের মর্মার্থ যে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা তা বুঝতে চেষ্টা করিনা। তাই আসুন আমরা শপথ নেই মাতৃভাষা বাংলাকে সর্বস্তরে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করব। সমুন্নত হোক ভাষা শহীদের সম্মান, সমহীমায় বেঁচে থাকুক মাতৃভাষা বাংলা।
লেখক: জসীম উদ্দীন, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।