অটিজম সচেতনতায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি

নবজাতক অাগমনের উচ্ছ্বাসে যখন পৃথিবী মহাকাব্য রচনা করে দু-এক লাইন কবিতা ছুড়ে, তখন ইতর প্রাণিটি কবির মুখের দিকে এক পলকে তাকিয়ে থাকে। কি বিষ্ময়ের সাথেই না পর্যাবেক্ষণ করে!

২/২.৫০ কেজি ওজনের ইন্দ্রীয়হীন প্রাণিটি যখন ধীরে ধীরে সামাজিক হয়ে উঠার চেষ্টায়, তখন বছর তিনেক পরে নানা বাঁধা বিপত্তির সৃষ্টি হয়। এই ধরুন প্রতিবন্ধী ও মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক অাচরণ (অটিজম)। ইত্যকার এইসব প্রতিবন্ধকতা দিনের পর দিন মাংস-পেশী ও মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলে প্রাণিটির শিশু থেকে প্রকৃত মানুষ রুপে গড়ে ওঠার প্রয়াস হয়ে উঠে না। সেই মুহূর্তে পরিবার ও সমাজ তাদের প্রতি বিরূপতা বিকটাকার ধারণ করিয়ে নিচ তলার অকর্মা মানুষরূপে গড়ে তুলে। এমন কোন সাহসী দম্পতি থাকে না যে তাদেরকে সক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে দিবে। সময় যত বর্তায় অক্ষমদের অারো পদদলিত করে হৃষ্টপুষ্ট হৃদয়টাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়। অন্দরমহলে ভূমিষ্ঠ হয় না কোন স্বপ্ন, উজ্জীবিত হয় না কোন প্রাণ। গোয়ালঘরে গরু বেঁধে রাখার মত বেকায়দায় পড়তে হয় শুধু মা নামক রাখালকে। সারাদিন সংসারের নানাবিধ কাজ শেষে যেটুকু সময় পায় তাও তো শাশুড়ির চুল বাঁধতে সময় চলে যায়। ননদীর হাজারও বায়না, শশুরকে চা দিয়ে গড়গড়ি করিয়ে দেওয়া, স্বামীকে অাফিসে বের করে দেওয়ার প্রস্তুতি। সময় কখন ঐ মস্তিষ্ক বিরূপের প্রাণিটাকে সামাজিক করে তোলার!

সমাজ যে বড়ই নিষ্ঠুর। মা ছাড়া অার কেই বা অাছে মনোমন্দিরে! কর্মক্ষম পুত্র-কন্যা যেন শুধু মা শব্দটার উপযুক্ত ব্যবহার জানে। পরিবারের বাকিদের তো তলানিতেও খুঁজে পাওয়া যায় না। সকালে ঘুম ভাঙানো থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত সকল উপকরণাদি সরবরাহে মা’ই শ্রেষ্ট।

হাবাগোবা, বুঝতে না পারা, চলতে না পারা সন্তানের দিকে অামাদের সমাজ তো চেয়েও দেখে না। কিভাবে তারা সামাজিকতার বিপ্লব ঘটাবে? যে সমাজ অামাদের পশুরূপ থেকে মানুষ রূপে গড়ে তোলার কথা, সেই সমাজই তো অবজ্ঞা, অসার অাচরণ, হীনমন্যতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কিসে হবে অাত্ম-বিশ্বাসী? কিভাবে হতে পারবে সকলের উর্ধ্বে? প্রতিবন্ধী এবং অটিস্টিক শব্দদ্বয় তাদের নামের বিশেষণ এটা তো কেউ খণ্ডানোর চেষ্টা করে না। অাবার বড় বড় বুলি ছুঁড়ে দেন- এদের জন্য দেশের ক্ষতি। কারণ তারা তো দু’টাকা অায়-রোজগার করতে পারে না, শুধু গলাধঃকরণই করতে পারে। এই ধরণের অতিরঞ্জিত বুলি ছুঁড়ে দেওয়া মানুষদের উচিৎ তাদের সুযোগ করে দেওয়া। পরিবারের সবাই তাদের পাশে সমান ভাবে সময় দেওয়া যেমন জরুরি, তেমনই তারা কি পছন্দ করে, কোন কাজটি তাদেরকে বেশি অাকর্ষিত করে এসবের প্রতি নজর দেওয়া। খুঁজে প্রস্ফুটিত করা উচিৎ তাদের সুপ্ত প্রতিভা। অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী অসংখ্য বিখ্যাত বিজ্ঞানী অাছেন, যারা পৃথিবীর সায়েন্টিফিক কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকা রেখে আজ চিরস্মরণীয় হয়ে অাছেন। অাল-বার্ট অাইনস্টাইন, স্যার অাইজ্যাক নিউটন, চার্লস ডারউইন এর মত বিজ্ঞানীরাও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ছিলেন।

বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমাজে অবহেলিত অটিজম ও প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন। তারা বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে বারংবার বলে থাকেন এটি কোনো মানসিক রোগ নয়, এটি মস্তিষ্কের একটি বিকাশগত সমস্যা, বংশগত সমস্যা, পরিবেশ দূষণ, রাসায়নিক মেশানো খাদ্য ইত্যাদির কারণে হয়ে থাকে। তাই বলে অামরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। তাদেরকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও সহায়তার মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটানোর প্রচেষ্টা অামাদের করতে হবে। যদি সেটা না করতে পারি তাহলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত অপরাধী হয়ে সমাজে বেঁচে থাকা ছাড়া অার উপায় থাকবে না। প্রথমে অামরা সবাই একই স্লোগানে সমাজ থেকে অঙ্গে প্রতিবন্ধী ও অটিজমে অাক্রান্ত শিশু/ব্যক্তিদের অন্তর প্রতিবন্ধী রূপটা দূর করি। অাত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা অামাদেরই দায়িত্ব।

জাতিসংঘে ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠানে তারা বলে অাসছেন, পৃথিবীতে প্রতিবন্ধী ও অটিজম শিশুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে তারা সোচ্চার হয়েছেন। বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে স্বাস্থ্য সচেতনতা কেন্দ্র, ট্রাস্টি বোর্ড ও প্রশিক্ষণ একাডেমি। বাংলাদেশেও এখন অসংখ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সরকারি-বেসরকারিভাবে সহযোগিতামূলক কর্মসূচি লক্ষনীয়। চলতি দশকে অাক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা-সেবা ও সহোযোগিতার গুনগত মান বৃদ্ধিকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখা সময়ের দাবী। পারমানবিকের অশুভ বিক্রিয়া ঘরে ঘরে সমস্যার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে, এদিকে লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশের মত দেশকেও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সৃজনশীল ভূমিকা রাখতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং তার সুযোগ্য তনয়া ‘সায়মা ওয়াজেদ পুতুল’ অটিজম এ্যাণ্ড ডিজঅর্ডারসদের উন্নয়নে যে অভয় বিশ্বের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন তা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশে যে সকল প্রতিষ্ঠান অটিজম ও প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা, পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম- জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে ‘অটিজম রিসোর্স সেন্টার’-মিরপুর, ঢাকা। ২০০১ সালে অান্তঃমন্ত্রণালয় ট্রাস্ট ফোর্স। ইন্সটিটিউট ফর পিডিয়াট্রিক্ নিউরো ডিজঅর্ডার এ্যাণ্ড অটিজম-(বিএসএমএমইউ) (এটি উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছে)। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও অাইসিডিডিঅারবি এর মাধ্যমে মায়েদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা। ★নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনে ‘একাডেমিক ফর অটিজম এণ্ড নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারস’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং ‘ন্যাশনাল অটিজম এণ্ড নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারস একাডেমি” স্থাপন শেষ হয়েছে। ঢাকা সেনানিবাসে ‘প্রয়াস’ নামক বিদ্যালয় উদ্বোধন করা হয়েছে। এটি চট্টগ্রাম, কুমিল্লায় সম্প্রসারণের কাজ চলছে। ২০০৮ সালে ২ এপ্রিল থেকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা’ দিবস এবং পরের বছর ২০০৯ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাবে এই দিবসটি পালন করা শুরু হয়। ২০১৩ সালে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারসে অাক্রান্তদের সুরক্ষা অাইনের অাওতায় এনে ডিজএ্যাবিলিটি ওয়েলফার অ্যাক্ট এণ্ড দ্যা ন্যাশনাল নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারস প্রটেকশন ট্রাস্ট অ্যাক্ট গঠন করা হয়। এছাড়াও অসংখ্য প্রতিষ্ঠান মস্তিষ্ক বা মানসিক অসারতা দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। অন্যদিকে অনেক সরঞ্জামের প্রস্তুতি পরিপূর্ণতা পেলেও সাধারণ মানুষের তেমন অানাগোনা নেই। স্ব স্ব জায়গা থেকে অসহায় প্রতিবন্ধী ও অটিজম শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে সকলের সমান উপস্থিতি জরুরী। এবারের বাংলাদেশ অাওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনী ইশতেহারের ১৯ নং দফায় অটিজম এবং প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যা নতুন সফলতার হাতছানি দিবে বলে অাশা করা যায়। এখন কার্যকারিতা দেখার বিষয়। মনে রাখতে হবে এটি কোন মানসিক রোগ নয়। তাই অটিজম সচেতনতায় অামাদের অারো সোচ্চার হতে হবে। বঞ্চিত,অবহেলিত প্রতিবন্ধী ও অটিজমে অাক্রান্তদের উপযুক্ত সেবা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশ ও জাতিকে সুপ্ত প্রতিভা উত্থানের মাধ্যমে বৈধ সমাজ উপহার দেওয়ায় হোক অামাদের কাম্য উদ্দেশ্য।

লেখক: মোঃ বোরহান উদ্দীন, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (৩য় বর্ষ)।