সামছুদ্দিন আজাদ: গত ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ বাংলাদেশ সফরে গেলাম পারিবারিক প্রয়োজনে। সফরের মেয়াদ ছিল ২৭ দিন। অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর যাওয়া ১০ জানুয়ারী নিউইয়র্ক মাটিতে পদার্পন করা। সফরের মূল উদ্দেশ্য একান্ত পারিবারিক।
আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে এই ভ্রমনে আমার দুই জেঠাতো বোন ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। তারা এখনও বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। এরই মধ্যে ডিসেম্বর ২০/২১ হয়ে গেলে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সম্মেলন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে। যেখানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের মাননীয় সভাপতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। মাননীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে পুনরায় দলের শীর্ষ নেতা হিসাবে এবং সাধারণ সম্পাদক হিসাবে পুনরায় জনাব ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হল সম্মেলনে ডেলিগেট আর কাউন্সিলরদের ভোটে। এটি ছিল এযাবত কালের সুসৃঙ্খল এবং সুসজ্জিত বিশাল সম্মেলন।
৫০ হাজারের বেশী নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ ছিল স্বতস্ফুর্ত এবং নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। এরি মধ্যে আমি ঢাকা-চট্টগ্রাম সন্দ্বীপ আমার নিজ এলাকায় বার বার আসা যাওয়া করেছি এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচী স্বচক্ষে দেখেছি। আমার কাছে উন্নয়নের দৃশ্যগুলো দেখে অবিশ্বাস্য আর অসাধারন মনে হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে, চট্টগ্রাম শহরে এমনকি সন্দ্বীপের বিভিন্ন অবকাঠামো গত উন্নয়ন কর্মকান্ডে দেখে। ঢাকা শহরের সবচেয়ে আলোচিত উন্নয়নের নাম মেট্রোরেল প্রকল্প। পুরা ঢাকা শহর জুড়ে চলছে মেট্রোরেল পথ নির্মানের কাজ। উত্তরার ১৫নং সেক্টর যাকে বলা হয় দিয়াবাড়ী এলাকা। জীবনে কখনও ঐসব এলাকায় যাওয়া হয়নি বা যাওযার প্রয়োজনও ছিল না।
শুধু মাত্র মেট্রোরেলের কার্যক্রম দেখার জন্য ঐ এলাকায় যাওয়া। সেখানে মেট্রোরেলের হেড কোয়ার্টার। পুরা নিয়ন্ত্রণ থাকবে ওখান থেকে এবং সারা ঢাকা শহর ব্যাপি যে লাইন গুলোর কাজ চলছে । ঝঃধৎঃরহম ঢ়ড়রহঃ ওখান থেকে শুরু করে পুরা শহর জুড়ে চলছে মেট্রোরেল এর কাজ। এ কাজটি হচ্ছে পাবলিক প্রাইভেট র্পাটনারশীপের মাধ্যমে। বাংলাদেশ, জাপান, ইতালীয় কোম্পানির মাধ্যমে এই বিশাল প্রকল্পের কাজ খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারনে রাস্তাঘাটে মানুসের স্বাভাবিক চলাচল একটু বিঘ্ন ঘটে, যান চলাচলও বিঘিœত হচ্ছে তবু মানুষ উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলো স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। আসলে কি হচ্ছে, মানুষ বিষয়টাকে সহজভাবে মেনে নিয়েছে এবং অপেক্ষা করছে কবে নাগাদ এমন সুন্দর স্বপ্নের মেট্রোরেলের চলাচল মানুষ দেখবে।
ঢাকা শহরের ভিতর সবচেয় বেশী মানুষের যেমন বসবাস, রাস্তায়, ফুটপাতে, ওভার পাস, আন্ডারপাস এ প্রচুর মানুষের ভীড় এবং চলাচল বিশেষ করে রাস্তা পারাপার ছিল সবচেয়ে বেশী বিপদজনক। রাস্তায় এতবেশি যানবাহন চলছে অনেকটা ছিল অনিয়ন্ত্রিত এবং বেপরোয়া। অনেক চালকের কোন লাইসেন্স ছিল না, প্রতিদিন দূর্ঘটনা ঘটতো মানুষ মারা যেতো। তাছাড়া সড়কে চলাচল করতো, লক্কর ঝক্কর মার্কা আনফিট গাড়ী। এখন আর ঐদিন নাই, যানবাহন চালকদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। শহরে দূর্ঘটনার হার কমেছে, লাইসেন্স বিহীন ড্রাইভার আর ফিটনেসবিহীন গাড়ীর সংখ্যাও নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয়েছে। আর পথচারীরা যত্রতত্র রাস্তা পারাপারের কোন সুযোগ নেইা। সুনির্দিষ্ট ওভারব্রীজ দিয়েই তাদের রাস্তা পার হতে হচ্ছে। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া রাস্তা পারাপারের এখন আর কোন সুযোগও নাই। মানুষের জীবন যাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ বিলাসী হয়ে উঠেছে। যেমন আমি একজন প্রবাসী হিসাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সবচেয়ে নামীদামী হোটেল গুলোতে ছিলাম পরিবারের সদস্যদের নিয়ে।
গুলশানের ২ এর ৪১ নং সড়কের একটি হোটেল নাম আমারি, প্রতি রাতে একটা রুমের ভাড়া দুইশত ইউএসডলার। দেখলাম একটি সিটও খালী থাকে না। বেশীর ভাগ বাংলাদেশের মানুষ ওখানে থাকে কিছু কিছু বিদেশীও থাকে। হোটেল সোনারগাঁ, সেরাটন সবগুলো হোটেলে মানুষের ভীড়, খুব সহজে সীট পাওয়া যায় না এসব হোটেল গুলোতে। শত শত গাড়ী হোটেলে ঢুকছে আর বেরুচ্ছে। আর আছে উবার, পাঠাও, ইয়োলো ক্যাবসহ অসংখ্যা প্রাইভেট যানের চলাচল। মানুষ আর ঘন্টার পর ঘন্টা যানের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। ২ মিনিটের মধ্যে উবার গাড়ী আপনার সামনে হাজির। দেশের ব্যাংকগুলোতে মানুষের টাকার পাহাড় জমে আছে। আমি দেখলাম প্রতিদিন যে হারে টাকা লেনদেন হচ্ছে ব্যাংগুলোতে এমন দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত এই ভেবে যে আমার দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির দৃশ্য দেখে। ঢাকা-চট্টগ্রামে অসংখ্যা উন্নত মানের নামী দামী খাবার হোটেল হয়েছে। হোটেলগুলোর দামী ডেকোরেশন, সত্যিই রুচী সম্মত। খাবারের মানও বেশ উন্নত। ২ থেকে ৪ জনের খাবার খেলে বিল আসে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার মত। মানুষ নির্ধিদায় খাচ্ছে যা খুশী, টাকার হিসাব কেউ করে না, যতই টাকা বিল আসুক মানুষ আনন্দ চিত্তে এমন খাওয়া উপভোগ করছে। কোথাও কারো কোন অভিযোগ শুনলাম না। হোটেল সোনারগাঁও এর সকালের নাস্তার দাম ১৭০০ টাকা, আর লাঞ্চ অথবা ডিনারের দাম ২৫০০ টাকা। একটা কপির দাম ৪০০ টাকা।
সব সময় মানুষ ভর্তি থাকে ডাইনিং টেবিল গুলোতে। ঢাকা সহরের বিলাশবহুল দুটি মার্কেট বসুন্দরা মার্কেট পান্থ পথে, আর যমুনা ফিউচার পার্ক মার্কেট প্রগতি স্বরনীতে, দুই মার্কেট ঘুরে দেখলাম। অসংখ্য ক্রেতার ভীড়, নারী পুরুষ নিজের পছন্দমত কেনাকাটা করছে, দরদামের কোন প্রশ্ন না তুলেই পছন্দ হলেই যতটা হউক কিনছে। তার পর দেখুন শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র, সারা দেশে যে কয়টা সরকারী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে তা জনসংখ্যার তুলনায় খুব কম, এগুলোতে আসনও সিমিত, কম সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সুযোগ পায়, তাহলে বাকী ছেলেমেয়েরা কোথায় ভর্তি হচ্ছে, নিশ্চয় বেসরকারী প্রাইভেট স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে, যেখানে ভর্তির খরচ টিউশন ফিসহ খরচ অনেক ব্যয় বহুল, কোন কোন প্রতিষ্ঠানে এক সেমিষ্টারের খরচ ৮০ থেকে এক লক্ষ টাকার মত। মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ আরও বেশী। তারপরও কোথাও কোন সিট খালি নেই, ছেলেমেয়েরা পড়া লিখা চালিয়ে যাচ্ছে। আসুন চিকিৎসা সেবা প্রসঙ্গ নিয়ে, সরকারী মেডিকেল কলেজ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল আমাদের দেশে। যারা সরকারী চিকিৎসার জন্য সরকারী হাসপাতালে যায় নিশ্চয় স্বাশ্রয়ীমুল্যে চিকিৎসার জন্য যায় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবচেয়ে ব্যায়বহুল বেসরকারী অথবা প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা।
দেখা গেছে ঢাকা শহরের সবচেয়ে ব্যায় বহুল হাসপাতাল এ্যাপোলো হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, ইবনে সিনা, স্কোয়ার হসপিটাল, পপুলার ডায়াগনিস্টক, গ্রীন লাইফ হসপিটাল, আনোয়ার খান মেডিকেল হসপিটাল, ল্যাব এইড হসপিটাল, এসব প্রাইভেট হসপিটাল ছাড়াও আর অসংখ্য হসপিটাল রয়েছে ঢাকা চট্টগ্রাম সহ সারা দেশে। এতবেশী মানুষের ভীড় থাকে এসব হসপিটালগুলোতে মানুষ একবারও টাকার কথা ভাবে না, কতটাকা, ব্যয় হবে এসব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা নিতে গেলে। এবার আসুন কাঁচা বাজার প্রসঙ্গে, কোন জিনিসের দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তেমন দেখলাম না। নিত্যদিনের খাদ্য যেমন চাল ডাল, মাছ, মাংশ, মুরগী, গরু, ছাগল ভেড়া বাজারে প্রচুর সরবরাহ। আমি নিজে আমার এলাকার সন্দ্বীপের এক বাজারে গেলাম, বাজারের নাম আকবর হাট, সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড় বাজার এটি। জীবন্ত ভেড়া কিনলাম একবার ৪টা, আরেকবার ২টি, এবং একটি গরুও কিনলাম। প্রতিটি বেড়ার দাম ৮০০০ টাকা করে কিনছি, একই সমান একটা খাসীর দাম ১২০০০ টাকা। আমি আমেরিকা থেকে গিয়ে বাজার দেখছি এবং কম্পেয়ার করছি, কোনটা কমদামে কেনা যায়, আর স্থানীয় লোকজন দামাদামী না করে যত টাকা বলে নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে খুব সানন্দে। পিয়াজের দাম নিয়ে ভানুমতির খেলা দেখলাম কতদিন, দামছিল আকাশ ছোয়া, কিছু কিছু অসৎ মানুষ পিয়াজ নিয়ে রাজনীতি করতে চেয়েছিল এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
টেলিভিশন আর সংবাদ মিডিয়াগুলো প্রতিদিন কোন কাজ না থাকলে দেশের কাঁচা বাজারে গিয়ে ক্যামরা নিয়ে গুড়াগুড়ি করে আর দ্রব্যমূল্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি মানুষের মাঝে এবং সরকার বিরোধী অবস্থান তৈরির চেষ্টা করে। কিন্তু তারা এটা খুজে দেখে না যে ক্রেতা ২০০ টাকা দিয়ে পিয়াজ কিনতে ভয় পায় সেই একই ক্রেতা তার স্কুল কলেজগামী কিশোরীর জন্য ৬০০০ টাকা দিয়ে লেহেঙ্গা কিনতে চিন্তা করেনা, ছেলের জন্য ক্যাটস আই থেকে ৩০০০ টাকা দামের জিন্সপ্যান্ট কিনতে একটুও ইতস্তত করে না, সেই খবর সাংবাদিক সাহেবরা রাখেননাা। তারা ব্যাস্থ থাকে পিয়াজ আর লবন নিয়ে, কাঁচা মরিচ আর বেগুন নিয়ে। প্রিয় পাঠক-এই ছিল আমার বাংলাদেশ ভ্রমনের বাস্তব চিত্র,¬¬ যা আমি একজন প্রবাসী হিসেবে স্বচক্ষে দেখলাম অবলোকন করলাম। আর আমি তা উপস্থাপন করলাম। পরবর্তি লিখায় ঢাকা চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপের উন্নয়নের বিশদ বর্ণনা দিয়ে লিখার প্রত্যাশা নিয়ে আপতত লিখা শেষ করলাম । ধন্যবাদ।
লেখক: সামছুদ্দিন আজাদ, সহ- সভাপতি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ।
প্রবাসী টিভির ইউটিউব চ্যানেলে যোগ দিতে এখানে ক্লিক করুন।