জাকির হোসেন, (শার্শা), যশোর: ফুলের রাজধানী নামে পরিচিত যশোরের ঝিকরগাছার গদখালী। এই ফুলের রাজধানীতে বসন্ত, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছেন ফুল চাষীরা। আর্থিকভাবে লাভবানের আশায় নারী পুরুষেরা মিলে ফুল বাগানে দিন রাত পরিশ্রম করছেন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখানকার ফুল বিদেশেও ছড়িয়ে পড়বে।
সরেজমিন দেখা গেছে, চাষীরা গোলাপের কুঁড়িতে পরিয়ে দিয়েছেন সাদা ক্যাপ। ফুল যাতে ফুল কিছুটা দেরি করে ফোটে। ১৩, ১৪ ও ২১ ফেরুয়ারির বাজার ধরতেই তাদের এই আপ্রাণ চেষ্টা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবার ২০ কোটি টাকার বেশি ফুলের বেঁচাকেনা করতে পারবেন বলে চাষীরা প্রত্যাশা করছেন। ২০১৭ বছরেও তারা এই সময়ে ২০ কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রি করেছিলো।
ঝিকরগাছা উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের মোকলেসুর রহমান এবার ২ একর জমিতে গোলাপ ফুলের আবাদ করেছেন। ফুলের ফলন ভালো হয়েছে। ফুলক্ষেতে তিনি ক্যাপ ব্যবহার করছেন। সামনের তিনটি দিবসের বাজার ধরতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিক্রির ২-৩ দিন আগে ক্ষেতের ফুলের ক্যাপ খুলে ফেলবেন। এসময় ফুল বাজার উপযোগী হবে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় সরকারি ও বেসরকারি অনুষ্ঠানে প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার হওয়ায় তারা ব্যবসায় মার খাচ্ছেনা বলে জানান তিনি। পানিসারা গ্রামের হারুণ অর রশিদ জানান, তিনি ২ বিঘা জমিতে জারবেরার আবাদ করেছেন। নববর্ষে ফুল বিক্রি না হলেও এবার সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চান তিনি। চলতি মাসে রয়েছে বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবস আর মহান শহীদ দিবস। ১৩ ফেরুয়ারি পয়লা বসন্ত, পরদিন ভালোবাসা দিবস। এ দুটি দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে মুখিয়ে আছে দেশের তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সীরা। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়নের বহু চাষী তাদের জমিতে ধান, পাটের চাষ চুকিয়ে সারা বছরই ফুল চাষ করছেন। তাদের উৎপাদিত রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল সারাদেশের মানুষের মন রাঙাচ্ছে। বিশেষ করে বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবসে এসব ফুলের বিকল্প নেই। আর ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও রয়েছে এ ফুলের ব্যাপক চাহিদা। তাই বছরের এ তিনটি দিবস ও অন্যান্য জাতীয় দিবসকে ঘিরেই হয় মূল বেঁচাকেনা।
পাটুয়াপাড়ার বাসিন্দা ফুলচাষী সাহিদা বেগম বলেন, ‘আমরা গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরিয়ে রাখি, যাতে ফুল একটু দেরি করে ফোটে। কেননা বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবস আর ২১ ফেরুয়ারিতে যাতে ফুল বাজারে দেওয়া যায়। প্রতিটি গোলাপে ক্যাপ পরানোসহ খরচ প্রায় পাঁচ টাকার মতো। যদি ৮-১০ টাকা বিক্রি করা যায় তাহলে ভালো মুনাফা হবে।
ফুলচাষী ও ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, এবার আমি ১৫ বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা, ডাবল রজনীগন্ধা (ভুট্টা) ও হাইব্রিড রজনীগন্ধা (উজ্জ্বল), গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা এবং গ্লাডিওলাস চাষ করেছি। ইংরেজি নববর্ষে ব্যবসা হয়নি। কিন্তু বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস এবং মহান শহীদ দিবসকে বেন্দ্র করে ৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রির আশা করছি। জারবেরা ফুল ব্যবসায়ী আশরাফুল আলমের সহযোগী রনি ইসলাম বলেন, এখন প্রতি সপ্তায় ৬-৭ হাজার পিস ফুল বিক্রি হচ্ছে। ফেরুয়ারি মাসের তিন উৎসবকে সামনে রেখে আমরা কমপক্ষে ৭ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সভাপতি ও গদখালি ফুল চাষী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘সারাদেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা এই ফুলকে কেন্দ্র করে। প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুলচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল যশোরেই প্রায় ৫-৬ হাজার ফুলচাষী রয়েছেন। সারা বছর টুকটাক ফুল বিক্রি হলেও মূলত ফেরুয়ারি মাসের তিনটি দিবসকে সামনে রেখেই জোরেশোরে এখানকার চাষীরা ফুল চাষ করে থাকেন। গেল বার এই তিনটি দিবসকে সামনে রেখে গদখালির চাষীরা প্রায় ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করেছিল। এবার ফুলের দাম বাড়ার কারণে ২০ কোটি টাকা বিক্রি ছাড়িয়ে যাবে। যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক এমদাদ হোসেন জানান, জেলায় ৬৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের আবাদ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুুকূলে থাকায় ফুলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। দেশে ফুলের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগই যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়। এখান থেকে ফুল বিদেশেও পাঠানো হয়।