সন্দ্বীপের নৌ দুর্ভোগ কি অনন্ত কাল চলবে?

সামছুদ্দীন আজাদ: সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে গত ১৮ই ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে পৌছালাম কুমিরা ঘাটে সন্দ্বীপ যাওয়ার জন্য। খুব সকালেই ঘাটে পৌছলাম এই ভেবে যে খুব সকালে স্পীড বোটে চড়ে সন্দ্বীপ গিয়ে নাস্তা খাব। ঘাটে এসে সব আশা গুড়ে বালি। দেখি অনন্ত ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ স্পীড বোটের টিকেট কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু টিকেট বিক্রি করছে না।
সন্দ্বীপ

ঘন কুয়াশার কারনে স্পীডবোট ছাড়বে না। সুতরাং আমিও একরকম হতাশ হয়ে শহরে ফিরে যাওয়া চিন্তা করছিলাম আর বার বার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলাম হয়ত দুপুরের দিকে সূর্যের আলো বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশা কেটে গেলে হয়তোবা স্পিডবোটছাড়তে পারে। কিন্তু মালিক পক্ষ জানিয়ে দিল আজ আর ছাড়বে না। পরে দেখলাম একই ঘাট থেকে মালবাহি ইঞ্জিন চালিত লঞ্চ ছাড়বে সন্দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাকে বলা হয় সার্ভিস বোট। প্রতি জনের টিকিটের মূল্য ১৫০ টাকা। শেষ পর্যন্ত অনেকটা রিস্ক নিয়ে সন্দ্বীপ পাড়ি দিলাম তাও নামিয়ে দেয়া হলো কোমর পানিতে।

প্রায় ১৫০ জনের মত যাত্রীকে নিয়ে কোমর পানিতে নামিয়ে দেয়া হল তাতে ছিল বিভিন্ন বয়সের মহিলা ও শিশুরাও। ঠিক একইভাবে সমুদ্রের স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য সন্দ্বীপের কুলে অপেক্ষমান ছিল অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষ। আবহাওয়া ভাল থাকলে স্পিডবোটখুব নিরাপদে এবং নির্বিগ্নে চলতে পারে মানুষ মাত্র ২০ মিনিটে এপার ওপার আসা যাওয়া করতে পারে এবং ভ্রমনটিও খুব আনন্দদায়ক হয়। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হরে স্পিডবোটছাড়া সম্ভব হয় না এবং তা বিপদজনকও বটে। সেক্ষেত্রে মানুষকে পড়তে হয় মহাদুর্ভোগে। প্রতিদিন শতধিক মানুষ কুমিরা এবং গুপ্তছড়া ঘাটে অপেক্ষমান থাকে নদী পারাপারের অপেক্ষায়। যখন কোন উপায় না দেখে মনে কষ্ট নিয়ে একটা গালি দেয় ঘাটের মালিককে, আর একটা গালি দেয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে।

আমার প্রশ্ন হলো এমন বিব্রতকর এবং বিপদসংকুল পরিবেশে সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম রুটে স্টিমার সার্ভিস কেন বন্ধ করে রাখা হল? খারাপ আবহাওয়ায় স্পিডবোট না চলতে পারলে মানুষ তো স্টিমার যোগে নদী পারাপার করতে পারতো তাকে তো দিনের পর দিন এভাবে ঘাটে এসে প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে হত না। স্বাধীনতার পূর্বে যেমন সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম রুটে স্টিমার  চলতো স্বাধীনতার পরও দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে স্টিমার  চলাচল অব্যহত ছিল। মেঘনার নাব্যতা হারানোর কারনে সদর ঘাট থেকে আসা স্টিমার  সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেলেও কুমিরা টু সন্দ্বীপ স্টিমার  সব সময় চলছিল। যখন স্পিডবোট ছিল না মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করতো আর আবহাওয়া খারাপ দেখলে কুমিরা থেকে স্টিমারে চড়ে সন্দ্বীপ চলে আসতো অথবা সন্দ্বীপ থেকে কুমিরা ঘাটে চলে যেত এবং এটাই ছিল স্বাভাবিক নিয়ম।

অথচ সন্দ্বীপ সহ গোটা দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ আসছে, রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে, বেড়িবাঁধ হচ্ছে, মডেল মসজিদ হচ্ছে, বলতে গেলে সবক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে সন্দ্বীপে অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় দ্বীপের মানুষের নিরাপদ যোগাযোগের দিকে কোন ভ্রক্ষেপ না করে ইচ্ছাকৃত স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করে রাখা হয়েছে বলে জনসাধারনের মুখে শুনেছি । কারন স্টিমার সার্ভিস থাকলে নাকি স্পীড বোটের ব্যবসার ব্যাঘাত ঘটবে। সুতরাং স্পিডবোটব্যবসাকে খুশি রাখার জন্য নাকি স্টিমার বন্ধ রাখা হয়েছে? আমার প্রশ্ন হলো স্পিডবোটচালায় প্রাইভেট কোম্পানী তারা তো সরকারি অনুমোদন নিয়ে এই ব্যবসা করে কিন্তু স্টিমার তো সরকারি কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিসি বাংলাদেশ আভ্যন্তরীন নৌ কর্তৃপক্ষ চালায়। সুতরাং সরকার কেন স্টিমার বন্ধ করে দেবে? আদৌ কি কর্তৃপক্ষ বন্ধ করেছে স্টিমার নাকি কারো ইশারা ইঙ্গিতে বন্ধ করে রাখা হয়েছে আমি জানিনা। ধরে নিলাম স্বাভাবিক কারনে স্টিমার বন্ধ রয়েছে তা হলে জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে এটি চালু করার দায়িত্ব কার? সন্দ্বীপের জনপ্রতিনিধিদের? নাকি স্থানীয় প্রশাসনের নাকি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের? নাকি নৌ পরিবহন মন্ত্রী মহোদয়ের? এ ব্যাপারে কেউ কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, দায়িত্ব নিচ্ছে না, সবাই নির্বিকার, মনে হয় যেন এটা কোন ভাবনার বিষয় না। মানুষকে অনেকটা বাধ্য করা হয়েছে স্পিডবোট পাড়ি দিয়ে যাতায়াতের জন্য মানুষ মরে গেলেও কারো কোন দায়দায়িত্ব আছে বলে কেউ মনে করেন না।

সন্দ্বীপ সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনা একটি দ্বীপ, সন্দ্বীপের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধশালী এটি একটি স্বাধীন ভূখন্ড ছিল। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সন্দ্বীপের বীর সন্তানেরা যেমন রক্ত দিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সন্দ্বীপের বীর সন্তানেরা অংশ নিয়ে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতায় অবদান রেখে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সন্দ্বীপের কৃতিপুরুষ বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, আরও বড়মাপের মানুষ উপমহাদেশে খ্যাত কমরেড মোজাফ্ফরের জন্মও সন্দ্বীপে। স্বাধীনতার পর পর যখন যারা এই দ্বীপের প্রতিনিধি ছিল একদিনের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া স্টিমার  বন্ধ হতে দেয়নি মানুষকে অনিশ্চয়তায় মাঝে থাকতে হয় নি। অথচ আজ সন্দ্বীপের নেতৃত্বে র্স্ববস্তরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান কারী ৭২বছরের পুরানা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জন প্রতিনিধি অথচ তারাই আজ কোন ভূমিকা রাখছে না, নিরবে নিভৃতে জন দুর্ভোগকে উপভোগ করছে এবং প্রতিনিয়ত সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলছে।

কেন এটি হচ্ছে, কোন অজ্ঞাত কারনে তা আমি জানি না। তা হলে আমি ধরে নিব সন্দ্বীপের মানুষের এমন সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে মুক্তির কোন পথ থাকলো না এই দুর্ভোগ চলবে অনন্ত কাল??

লেখক: সহ-সভাপতি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ।

প্রবাসী টিভির ইউটিউব চ্যানেলে যোগ দিতে এখানে ক্লিক করুন।

ইতিহাসের পাতার সুপারহিট: