একাত্তরের ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে অপারেশন নামে ইতিহাসের র্নিমম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের মদদ পুষ্ট বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের উপর অতর্কিতে গুলি করে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। রাজধানী ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে হামলা ও নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। এটা ছিল তাদের এক সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। এমতাবস্থায় হামলাকারীদের হীন উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে কোন প্রকার পূর্ব ঘোষণার অপেক্ষা না করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন অনেক সাহসি সচেতন নাগরিক।
পরবর্তীতে এক আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে আপামর জনসাধারণ হামলাকারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে ঝাপিযে পড়ে। ২৫শে মার্চের ওই গণহত্যা ছিল বাঙালী জাতিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার এক অপচেষ্টা। যা তারা পারেনি এবং পার্থিব কোন শক্তিই পারবে না। অপ্রতিরোধ্য দুর্দমনীয় এক জাতির নাম বাঙগালী জাতি। দীর্ঘ ৯টি মাস প্রাণ ও সম্পদক্ষয়ী যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে এবং পরে বাংলাদেশ নামে একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি দেশের নাম যুক্ত হয়, লাল-সবুজ পতাকায় মোড়ানো সে দেশের নাম বাংলাদেশ। ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস আমাদের এক কালজয়ী অহঙ্কারের দিন। উষ্ণ রক্তেভেজা মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকাকে সমুন্নত করার দিন। অপশাসনে শৃঙ্খলীত জাতীর পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল।
তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকরা যখন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিদের অনৈতিক শোষণ ও অর্থনৈতিক অসমতার, পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ঠিক তখনই দৈব চয়নে মহাকালের মহানায়ক জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপন করলেন বাংগালী জাতীর অন্তরে। বীর বাঙালীরা এই মহামন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নিজেদের মুক্তির লক্ষ্যে উজ্জীবিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে। এর পূর্বে ১৯৭০ সালে, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালী জাতীর দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রের ক্ষমতা বাঙালীদের দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাদেও হাতে কুক্ষিগত করে রাখার হীনচক্রান্তে লিপ্ত ছিল।
ওই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার প্রাণকেন্দ্র রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল এক জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি দিক নির্দেশনা মূলক ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত ওই ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কালজয়ী ভাষণে জনমনে স্বাধীনতা লাভের অদম্য আগ্রহ সৃষ্টি হয়।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ১৮মি: স্থায়ী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিদের ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিলেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক ওই কালজয়ী ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ দেশের হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সর্বস্তরের জনগণ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে বজ্রকঠিন মনোবল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গৌরবোজ্জ¦ল রক্তক্ষয়ী, প্রাণনাসী সশস্ত্র ৯মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বাংলার জনগণ অর্জন করে লাল-সবুজে ঘেরা স্বাধীনতা। নিপীড়িত বাংলার মেঘমুক্ত আকাশে উদিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য্য। এ দেশের দামাল ছেলেদের প্রাণের বিনিময়ে, তাজা রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল। তাই এ স্বাধীনতা আজ আমাদের অহংকার।পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনার মাধ্যমে আত্মত্যাগের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো এ জাতি। একাত্তরের এই দিন মহান স্বাধীনতা লাভের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের মানুষ। দীর্ঘ ৯মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনই তার চূড়ান্ত সফলতা। এ দেশের গণমানুষের কথা বলার অধিকার ন্যায্য সম্পদের অধিকার নিশ্চিত করাই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র আদর্শ ও লক্ষ্য। এই স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের অন্তরের মণিকোঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরভাস্কর হয়ে থাকবেন যুগ-যুগ ধরে।