নাঈম হোসাইনঃ সমুদ্রের সবচেয়ে উপরের লেয়ারের নাম সানলিট জোন। পানির উপর ঠেকে শুরু করে প্রায় ৬০০ ফুট (২০০ মিটার) পর্যন্ত জায়গা আলোর রাজ্য। সানলিট জোন হলো পুরা সমুদ্রের শক্তিঘর। হাজার হাজার পিচ্চি পিচ্চি ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন সূর্যের আলো থেকে শক্তি নিয়ে এখানে খাবার বানায় পুরা সমুদ্রবাসীর জন্য। ফাইটপ্ল্যাঙ্কটন দের খায় জুওপ্ল্যাঙ্কটনরা, ছোট্ট ছোট্ট চিংড়ি, মাছের বাচ্চা, হাইড্রা আর প্রবালের ছানাপোনারা। তাদেরকে খেয়ে বেঁচে থাকে মাছের ঝাঁক। এই স্তরে তিমি থাকে, ডলফিন থাকে, প্রবাল থাকে, আমাদের পরিচিত প্রায় সব মাছ এখানে বাস করে।
২০০ থেকে ১০০০ মিটার পর্যন্ত গভীরতার নাম টোয়াইলাইট জোন। একদম ভোর রাতে সূর্য ওঠার আগে আগে, আর সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার অনেকক্ষণ পর পৃথিবীতে যখন খুব অল্প অল্প আলো থাকে, সেই সময়টার নাম টোয়াইলাইট। নীল আলোর ফ্রিকোয়েন্সি সবচেয়ে বেশি, শক্তি তাই অনেক। একেবারে গারো নীল আলো ছাড়া আর কোন আলো এই স্তরে আসতে পারে না। মানুষের ডাইভিং রেকর্ড ৩৩২ মিটার, মোটামুটি একটা ১০০ তলা বিল্ডিঙকে উলটা করে ডুবালে যা হবে তাই। এই গভীরতায় পানির চাপ ৩২ বায়ুমণ্ডলীয় চাপের সমান, এই প্রচণ্ড চাপে এমনকি অক্সিজেনও রক্তে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই স্তরে ডাইভ দিয়ে বেঁচে ফিরে আসা মানুষদের তালিকা খুব ছোট।
টোয়াইলাইট জোনে বাস করে ভূতুরে সব প্রাণীরা। তাদের কারো কারো বিশাল বিশাল চোখ, কেউ বা পুরাপুরি স্বচ্ছ, কেউ আলোর ঝলকানি দিয়ে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্ধকারের দুনিয়ায়। এই স্তরে খাবারের খুব অভাব, তাই প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় উপরের স্তরের বড় বড় দানবরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে, খাবারের সন্ধানে ভুতের দল উঠে আসে টোয়াইলাইট জোন থেকে। তাদের গল্প আজকে না, সামনের কোন পর্বে হবে। আমাদের পরিচিত সাবমেরিনগুলোর সীমা টোয়াইলাইট জোন পর্যন্তই।
পানির ১০০০ থেকে ৪০০০ মিটার পর্যন্ত জায়গার নাম মিডনাইট জোন। দিনের আলোতেও সেখানে কুচকুচা কালো অন্ধকার। মধ্যরাতের দুনিয়ায় ক্ষুধার রাজ্য, শক্তির খুব অভাব সেখানে। দানবরা সেখানে বড় হয় খুব ধীরে ধীরে, বাঁচে অনেক দিন, নড়ে চরে একেবারে আস্তে আস্তে, আর খাবার কাছে আসলে বিশাল বড় মুখ হা করে টুপ করে গিলে ফেলে। অস্বাভাবিক, পাগল করা পানির চাপ সেই দুনিয়ায়। ওখানে যারা থাকে তাদের শরীর হয় তরলে ভরা।
মিডনাইট জোনে যদি ঘুরতে জান, এক আশ্চর্য নক্ষত্রের রাজ্যে ঢুকে পরবেন। চারপাশে গভীর কালো অন্ধকার, তার মধ্যে বাতি জ্বেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে আশ্চর্য সব বিদঘুটে প্রাণীরা – মাছ, জেলিফিশ, হাজার হাজার ভূতুরে অপরিচিত জিনিস। আলো জ্বেলে একে অপরের সাথে কথা বলছে, খাচ্ছে, আর খাবার হওয়া থেকে বাঁচছে। এদের গল্পও, অন্য কোনদিনের জন্য রেখে দিলাম।
গভীর সমুদ্র খুব ঠাণ্ডা, তাপমাত্রা বরফের কাছাকাছি। আরও নামতে থাকলে, ৪০০০ থেকে ৬০০০ মিটার গভীরতায় আমরা এসে পৌঁছব অ্যাবিসাল জোনে। বেশিরভাগ গভীর সমুদ্রের তলা এই জায়গায়। এই দুনিয়ায় বাস করে ব্রেইনলেস উদ্ভট সব দানবরা। নানান জাতের স্টারফিশ, টুর্নিকেট, প্রোটোকর্ডাটা আর কিছু সাহসী মাছদের বাড়ি গভীর সমুদ্রের তলা। এই জায়গায়, অনেক সময় দেখা যাবে সমুদ্রের নিচে ঘন ব্রাইনের লেক, থাকবে পৃথিবীর গভীর থেকে উঠে আসা মিথেইন সিপ, আছে ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ আর হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট। এই ভেন্ট গুলোতে সুর্জের আলোর কোন রকম সাহায্য ছাড়া কেমোসিন্থেসিস করে গড়ে উঠেছে নিজস্ব এক ইকোসিস্টেম। আজ থেকে সাড়ে তিনশ কোটি বছর আগে এমনি এক গভীর সমুদ্রের আগ্নেয়গিরির আশেপাশে জন্ম হয়েছিলো পৃথিবীর প্রথম প্রাণ।
৬০০০ থেকে ১১০০০ মিটার হলো সমুদ্র খাদগুলোর গভীরতা। গ্রিক পুরাণ মতে, মাটির নিচে আছে অন্ধকারের দুনিয়া, সেখানে রাজত্ব করে অমঙ্গল আর মৃত্যুর দেবতা হেডিস। হেডিসের নামে এই দুনিয়ার নাম হ্যাডাল জোন। এভারেস্ট পর্বতকে উলটা করে ডুবালেও এই স্তরের তলা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এইখানে কি আছে আজকে আর না বলি, শুধু জেনে রাখি, এই পর্যন্ত যত মানুষ চাঁদে গিয়েছে তার চেয়ে অনেক কম মানুষ নেমেছে হ্যাডাল জোনে।হেডিসের দুনিয়া পৃথিবীর শেষ রহস্যের জায়গাগুলোর একটা।