বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার মহাকাব্য

সামছুদ্দীন আজাদ: ৭ই মার্চ বাঙ্গালী জাতির জীবনে এটি অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ দিন হিসাবে স্বীকৃত। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বর্তমান সোহরাওর্য়াদী উদ্যানে বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষনটি দিয়েই স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে ছিলেন। আর সেই কারনে ৭ই মার্চ বাঙ্গালী জাতির জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে লক্ষ লক্ষ বীর বাঙ্গালীর সামনে বঙ্গববন্ধু তার ভাষনটি যে ভাবে শুরু করেছিলেন তার কিছু অংশ এখনে উপস্থাপন করেই আমি আমার রাজনৈতিক বিশ্লেষনে যাব।

“আজ দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।

আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয় , আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।

আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।

কি অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূন ভাবে আমাকে আওয়ামীলীগকে ভোট দেন।

সামছুদ্দীন আজাদ

আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলী বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ  অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বছরের করুন ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেও আামরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শালল, জারী করে দশ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম।

প্রায় শেষ অংশের ভাষনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা। আমরা এদেশের শানুষের অধিকার চাই। আমি পরিস্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজি থেকে এই বাংলাদেশে কোট কাচারী, আদালত ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনিদিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যন্য জিনিষগুলো আছে সে গুলোর হর্তাল কাল  থেকে চলবে না। রিকসা, গরুর গাড়ী চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে, শুরু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোট, হাই কোট, জর্জ কোট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তর গুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্ম চারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রু মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে, রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো, তোমরা আমর ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।

কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাতকোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।

সর্ব শেষ বক্তব্যে  তিনি বলেছেন, প্রত্যেকে গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো। ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা, জয় বাংলা।

১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ পাকিস্থান জাতীয় পরিষদে নিরন্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠাতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্থানের কেন্দ্রিয় শাসক গৌষ্ঠী আওয়ামীলীগের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে। পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া যখন ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন এবং ১লা মার্চ আবার অনিদিষ্ট কালের জন্য অধিবেশন মুলতবি ষোষনা করেন এবং এর প্রতিবদে পূর্ব পাকিস্থানে তীব্র আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু হয়।

আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ৩রা মার্চ পল্টনের জন সভায় তিনি সারা পূর্ব পূর্ব বাংলায় সর্বাত্বক অসহযোগ আন্দোলনের কর্ম সূচী ঘোষনা করেন। আর এই আন্দোলনের পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে সমবেত উত্তাল জন সমুদ্রে জাতির উদ্দ্যেশ্যে তার  ঐতিহাসিক ভাষনটি উপস্থাপন করেন।

প্রিয় পাঠক আপনাদেরকে জানান দেয়ার জন্য আজকের ৭ই মার্চের ভাষনের কিছু অংশ বিশেষ যা আমি এখানে উপস্থাপন করেছি সেটি ভাল ভাবে পড়লে বুঝতে পারবেন।, বঙ্গবন্ধু তার ভাষনে কি বলতে চেয়েছিলেন। মূলত এই ভাষনটিই ছিল বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সনদ। এই ভাষনের মাধ্যমে মাত্র ১৮ মিনিটের বক্তব্যে পাকিস্থানী স্বৈর শাসনের ২৩ বছরের শাসনের নামে নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। দীর্ঘ ২৩ বছর বাঙ্গালীর ঘুরে দাড়ানোর সময় এসেছে বাঙ্গালীকে ঘুরে দাড়াঁতে হবে স্বৈরচারী আয়ুব ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে। দেখুন তিনি কত বেশী গনতান্ত্রিক এবং সহনশীল ছিল। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা ও পেয়েছেন। সংখ্যা গরিষ্ঠদলের নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধুকে বানানোর কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বকে গ্রহন করেননি। বলেছিল আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চায় না। আমি এদেশের মানুষের অধিকার চায়। তারপর ও ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ এর ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করে আবার ১লা মার্চ অনিদিষ্ট কালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মূলতবি ঘোষনা করেছেন। আর তখনই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেক মুজিব অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে ঐক্যবদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের তার ঐতিহাসিক ভাষটি উপস্থাপন করেন। পাকিস্থানী স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে তিনি চ্যালেঞ্জ ঘোষনা দিয়ে তিনি হর্তাল আহবান করে বলে দিয়েছেন, পূর্ব বাংলার অফিস, আদালত, শিল্প কল কারখানা তার নির্দেশে চলবে, হরতালে সব কিছু বন্ধ থাকলেও কর্মকর্তা কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছেন ২৮ তারিখের মধ্যে যেন তারা বেতন নিয়ে আসে। এমন সাহস আর কঠিন চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করার মত বুকের পাটা, কোন মাদার সনের তখন ছিল না। কেবল বঙ্গবন্ধু ছাড়া। তিনি এও বলে দিয়েছেন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, বুঝাতে চেয়েছেন আমাকে যদি গ্রেফতার করা হয়, তোমরা প্রস্তুত থাকবে, তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার নির্দেশ ও তিনি দিয়ে গেছেন। বক্ত্যেবের শেষ পংক্তি ছিল এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। যে কঠিন সংগ্রামে আমরা অবর্তীন হতে যাচ্ছি শীঘ্রই সেই সংগ্রাম হবে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির সংগ্রাম এবং ২৩ বছরের গোলামীর জিনঞ্জির থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রাম এবং জয় বাংলা হবে স্বাধীন বাংলার শ্রেষ্ঠ শ্লোগান। সব নিদেশনা বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন তার এই ভাষনে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষনের সাথে কেবল তুলনা হতে পারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিজবার্কের ভাষনের সাথে যা তিনি ১৮৬২ সালের নভেম্বরের ১৯ এ দিয়েছিলেন। “fore score and Seven years ago our fathers brought forth in this continent a new Nation conceived in liberty and dedicated to the position that all men created equal”

লেখক: সহ-সভাপতি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ।

প্রবাসী টিভির ইউটিউব চ্যানেলে যোগ দিতে এখানে ক্লিক করুন।

ইতিহাসের পাতার সুপারহিট: